শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০১:৪৪ অপরাহ্ন

পোস্টমাস্টারের রতন

পোস্টমাস্টারের রতন

ইসমত আরা জুলী: রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ ছোটগল্প রচিত হয়েছে বাংলা ১২৯৮ সাল থেকে ১৩১০ সালের মধ্যে। অবশ্য ১৩১৪ সাল থেকে ১৩২৫ সাল পর্যন্ত আরও বেশ কয়েকটি ছোটগল্প রচিত হয়। বিখ্যাত ও বহুল আলোচিত পোস্টমাস্টার গল্পটি ১২৯৮ সালে লেখা। এর মাত্র কিছু দিন আগে তিনি পূর্ব বাংলার পদ্মা পাড়ের বিস্তীর্ণ জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়েছেন। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে বেড়ে ওঠা সহজ সরল গ্রাম্য জীবনের মধ্যে তিনি বাস্তবের পোস্টমাস্টারকে খুঁজে পেয়েছেন এবং তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করেছেন বিখ্যাত ছোটগল্প পোস্টমাস্টার।
এই ছোটগল্পটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার ছোটগল্পগুলোর অন্যতম। একটি স্বজনহারা নিঃসহায় গ্রাম্য বালিকার স্নেহালোলুপ হƒদয়ে আসন্ন স্নেহবিচ্যুতির আশঙ্কায় কী সকরুণ ভাবাবেগ উদ্বেলিত হয়েছে তা গল্পের শেষাংশে প্রতিফলিত হয়েছে এবং পাঠকের হƒদয়ে তা অনুরণিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। গল্পের শেষের এই করুণ রসটুকু পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে দীর্ঘক্ষণ। দুটি অসম সামাজিক স্তরের নর-নারীর হƒদয়ের সম্পর্ককে লেখক উপলব্ধি করেছেন হƒদয় দিয়ে। অনাথ বালিকা রতন যে সামাজিক পরিবেশের প্রতিনিধিত্ব করছে পোস্টমাস্টার প্রতিনিধিত্ব করছে ঠিক তার উল্টো সামাজিক পরিবেশের। তরুণ পোস্টমাস্টার যে কলকাতার ছেলে এবং উলাপুরের মতো হতদরিদ্র একটি গ্রামে এসে তার দশা যে ‘জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুলিলে’ যেমন হয় তেমন হয়েছে সে কথা আমরা জানতে পারি গল্পের শুরুতে। নব্য ইউরোপীয় সভ্যতার ছোঁয়া লাগা কলকাতা শহর আর উলাপুরের মতো অজপাড়াগাঁয়ের অবস্থান স্পষ্টত দুই মেরুতে, গল্পের দুটি চরিত্রের মতো। প্রকৃতিতে বর্ষাকালের ছোঁয়া দিয়েই রবীন্দ্রনাথ রতন ও পোস্টমাস্টারের হƒদয়কেন্দ্রিক সম্পর্কের শুরু এবং শেষ টেনেছেন। বর্ষাকালের মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহর, ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস, রৌদ্রে ভিজা ঘাস ও গাছপালার গন্ধ, এক নাছোড়বান্দা পাখির একটানা সুরের নালিশ, বৃষ্টিধৌত মসৃণ চিক্কণ তরুপল্লবের হিল্লোল, পরাভূত বর্ষার ভগ্নাবিশিষ্ট রৌদ্রশুভ্র স্তূপাকার মেঘস্তর প্রকৃতির এই পটভূমিতে পোস্টমাস্টারের মনে একাকীত্বের অনুভূতি প্রবল হয়ে উঠেছিল। ‘হƒদয়ের সহিত একান্ত-সংলগ্ন একটি স্নেহপুত্তলি মানবমূর্তি’র কল্পনা এটা স্পষ্ট করে যে তার মনে প্রেম জাগ্রত হয়েছে। বালিকা রতনকে পড়া শেখানোর বিষয়টি রূপক অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। পোস্টমাস্টার স্বরবর্ণ শিখিয়েছেন, এ যেন হƒদয়বোধের স্বরবর্ণের পাঠ নেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর ঘটনা। পোস্টমাস্টারের স্নেহকে কেন্দ্র করে রতনের মধ্যে হƒদয়ঘটিত সম্পর্কের সূচনা ঘটে। যুক্তাক্ষর শুধু বাংলা বর্ণমালার প্রতিনিধিত্ব করে না, এটি দুটি হƒদয়কে যুক্ত করার মানবিক প্রক্রিয়াকেও প্রতিফলিত করে।
এই গল্পে মূলত তিনটি চরিত্র-পোস্টমাস্টার, রতন ও প্রকৃতি। গল্পের নাম পোস্টমাস্টার হলেও গল্পের প্রধান চরিত্র হচ্ছে রতন। গল্পটিতে প্রকৃতি কেবলমাত্র স্থানিক ও ভৌগোলিক পরিচয় বহন করেনি, গল্পের প্রধান দুটি চরিত্রের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করেছে, প্রকৃতি ও মানবমন কখনও বা সমান্তরালভাবে চিত্রিত হয়েছে। গল্পের বিস্তার ও পরিণতিতে প্রকৃতি অমোঘ প্রভাব বিস্তার করেছে। গল্পটির মোট সময়কাল নির্ধারণ করা না গেলেও এটা যে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে তার ইঙ্গিত এ গল্পে স্পষ্ট করা হয়েছে। এই গল্পজুড়ে বর্ষা ঋতুকে চিত্রিত করা হয়েছে তাই বলা যেতে পারে যে এটি কোন এক বর্ষাকালেরই। বর্ষাকালের মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহর এই সময়টাতে রতন ও পোস্টমাস্টার পরস্পরের হƒদয়ের কাছাকাছি এসেছে, গল্পের মাঝের অংশে কিংবা সম্পর্কের মধ্যভাগেও রয়েছে শ্রাবণের অন্তহীন বর্ষণ এবং গল্পের শেষাংশে পোস্টমাস্টারের বিদায় যাত্রায় রয়েছে বর্ষাবিস্ফোরিত নদীর বর্ণনা। কেবল পটভূমি রচনাতেও নয়, প্রকৃতিতে বর্ষার ছবি বেশ কিছু জায়গায় রতনের আবেগকে চমৎকারভাবে ইঙ্গিত করেছে। রতনের অশিক্ষাকে দূর করার চেষ্টায় পোস্টমাস্টার রতনকে নিয়মিত অক্ষরজ্ঞান দিতে শুরু করল।
পোস্টমাস্টারের আন্তরিকতা রতনের মনে ভালোবাসার বীজ বুনল, রতন মহা আনন্দ নিয়ে যুক্তাক্ষর পর্যন্ত শিখে ফেলল। পোস্টমাস্টার ও রতনÑ এই দুটি চরিত্রের শ্রেণিগত অবস্থান ভিন্ন। এ ভিন্নতা জোরালো হয়েছে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে। যদিও পোস্টমাস্টার উচ্চবিত্ত শ্রেণির নয়, সে সামান্য বেতনের একজন পোস্টমাস্টার কিন্তু রতনের অবস্থান তার অনেক নিচে, মনিবভৃত্যের সম্পর্কের মতো কারণ কাজের বিনিময়ে রতন চারটে খেতে পায়। খানিকটা বর্ণনা ও খানিকটা কথোপকথনের রীতিতে গল্পটি নির্মাণ করা হয়েছে। গ-গ্রামে পোস্টমাস্টারের একাকীত্ব দূর করেছে হতদরিদ্র বালিকা রতন। তাকে সে সঙ্গ দিয়েছে, সেবা দিয়েছে, গ্রাম্য সারল্যে তাকে আপন করে নিয়েছে। পোস্টমাস্টারের ঘরের লোকদের সে নিজের অজান্তেই মা, দিদি, দাদা বলে সম্বোধন করতে লাগল। লেখাপড়া শেখার ফাঁকে ফাঁকে পোস্টমাস্টার ও রতনের গল্প জমে উঠতে লাগল। পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লে দিনরাত সেবা করে তাকে সুস্থ করে তুলল। সে সময় লেখকের উচ্চারণে ‘বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না’ এই কথাটিতে পাঠকমাত্র বুঝতে পারে যে সে শুধু জননীর পদ অধিকার করে নাই, প্রেমিকার পদেও নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছে। পোস্টমাস্টার চলে যাওয়ার কথা রতনকে বলার পরপর পুরো পরিবেশটা এভাবে চিত্রিত হয়েছে অনেকক্ষণ আর কেউ কোন কথা কহিল না। মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার ওপর টপটপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল। এ চিত্রটি রতনের মনের অবস্থাকে চিত্রিত করে। পোস্টমাস্টারের প্রতি রতনের প্রেমের সূত্রটি খুবই ক্ষীণ মিটমিট করে জ্বলা প্রদীপের মতো এবং আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় রতনের হƒদয়বেদনা টপটপ করে পড়া বৃষ্টির জলের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘দাদাবাবু আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?’ এবং ‘সে কী করে হবে ‘-এই দুটি সংলাপ অসম সামাজিক স্তরের দুটি মানব-মানবীর বাস্তব অবস্থানকে চিহ্নিত করে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মতে পোস্টমাস্টার গল্পটিতে রবীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই প্রেম রচনা করে আসছিলেন। তার মতে রতনের প্রেম তার আপনার গড়া; রতনের প্রেম তার আপনার ভেতরেই থেকে গেছে শেষ পর্যন্ত। গল্পের শেষাংশের দীর্ঘশ্বাসজনিত উচ্চারণ ‘হায় বুদ্ধিহীন মানব হƒদয় ‘রতনের নারী প্রেমকে উপস্থাপিত করে।
প্রেমিকা রতন আবেগ দ্বারা তাড়িত, পোস্টমাস্টারের বিচ্ছেদে পাগল প্রায় আর অন্য দিকে পোস্টমাস্টারের হƒদয়ে রতনের জন্য প্রেম থাকলেও তা সে বাস্তবের তাড়নায় তা অস্বীকার করে ‘পৃথিবীতে কে কাহার ‘এই ভেবে সামনে এগিয়ে যায়, অজপাড়াগাঁ ছেড়ে কলকাতা শহরের দিকে তার মন ধাবিত, তাই ফিরে যাবে কি না এই দ্বিধাকে সে সহজে এড়িয়ে যেতে পারে। দুই সামাজিক মেরুর দুই প্রান্তের দু’জন নর-নারীর পক্ষে সমাজকে অস্বীকার করে শুধু হƒদয়ের টানে সারা জীবন কাছাকাছি থাকার স্বপ্ন দেখা রবীন্দ্রনাথের সময়ের সমাজ বাস্তবতায় একেবারে সম্ভব ছিল না, এখনও যে সম্ভব তা জোর দিয়ে বলা যায় না।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877